পূর্ববর্তী ইমামগণের মতভিন্নতায় বিভেদ ছিল, বিচ্ছিন্নতা নয়!
সুপ্রিয় পাঠক!
সামান্য মত পার্থর্ক্যরে জের ধরে সাধারণ সমাজের কথা বলা তো বাহুল্যই, আমাদের ওলামা কেরামের মাঝেও যে কী ধরনের গিবত-পরনিন্দা, বকাবাজি আর গালবাজি দেখা যায় তা অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় অত্যন্ত ভয়াবহ। কিন্তু আমাদের পূর্ববর্তী ইমামগণের মতভিন্নতা, পারস্পরিক চিন্তা-চেতনা, পথ ও পন্থায় নিজ নিজ ভিন্নতা সত্ত্বেও তারা পরস্পরে একে অপরের সাথে হৃদ্যতা ও ভালবাসা, বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্ববোধ, আশ্রয় ও অনাড়তা, মূল্যায়ন ও মর্যাদাবোধের প্রতি কতটা যত্নবান ছিলেন সে সম্পর্কে আমাদের কিছুই জানা নেই। যার ফলে আজ আমাদের এই আদর্শচ্যুতি।
এ সম্বন্ধীয় শিক্ষনীয় ঘটনার বর্ণনা রয়েছে অনেক। আমাদের সেরে তাজ আকাবির ও বিদগ্ধ ইসলামী চিন্তাবিদ মরহুম আল্লামা শাইখ আব্দুল ফাত্তাহ আবূ গুদ্দাহ রহ. আজকের মুসলিম জাতির কল্যাণে বুক ভরা দরদ নিয়ে এ বিষয়টি লিখে গেছেন। বারংবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন নতুন প্রজন্মের ওলামায়ে কেরামগণের প্রতি। তন্মধ্য হতে এখানে কয়েকটি ঘটনা তাঁরই ভাষায় প্রদত্ত হলো।
পূর্ববর্তী ইমামগণের মতভিন্নতার ৯টি আদর্শিক নমুনা
(১) ইমাম শাফেয়ী রহ. ও ইমাম আবূ মূসা রহ.
হাফেজ যাহাবী سير اعلام النبلاء নামক গ্রন্থে ইমাম শাফেয়ী (রহ.) এর জীবনীতে ইমাম হাফেজ আবূ মূসা ইউনুস বিন আব্দুল আ‘লা আস সাদাফী আল মিসরী (যিনি ইমাম শাফেয়ী (রহ.) এর একজন শিষ্য ছিলেন) থেকে বর্ণনা করেন যে তিনি বলেছেন-
(আমার জীবনে) আমি ইমাম শাফেয়ী (রহ.) এর চেয়ে অধিক আকলমন্দ ও বুদ্ধিমান আর কাউকেই দেখিনি। আমি একদিন তার সাথে একটি মাসআলা নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হলাম।
বিতর্কের এক পর্যায়ে আমরা নিজ নিজ মতামতে বহাল থেকে বিভক্তি নিয়ে ফিরে গেলাম। কিন্তু তিনি আমার সাথে সাক্ষাৎ করলেন। আমার হাত ধরলেন আর বললেন আবূ মুসা! জেনে রেখো! আমরা পরস্পর ভাই ভাই । এ কথাটি তো সস্থানে সুদৃঢ়, যদিও কিনা কোন মাসআলায় আমরা একমত হতে না পারি!
যাহাবী বলেন- এটাই এই ইমামের আকল ও বুদ্ধিমত্তা এবং তার ফেকাহর পূর্ণতার প্রতি নির্দেশ করে।
(২) ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ. ও ইমাম ইসহাক রহ.
তিনি سير أعلام النبلاء নামক গ্রন্থে ইমাম ইসহাক বিন রাহুয়াহ- এর জীবনীতে এ কথাও উল্লেখ করেছেন-শায়খ ইবনে আদী আহমদ বিন হাফস আস সা‘দী বলেছেন- আমি ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলকে বলতে শুনেছি-ইসহাকের মত কোন আলেম ও ব্যক্তিত্ব খোরাসানের বাধ অতিক্রম করেনি। যদিও সে কিছু বিষয়ে আমাদের মুখালাফাত করেছে। ( এতে আশ্চর্যেরই বা কী আছে) মানুষ তো একে অপরের মুখালাফাত করতেই থাকবেই (অনন্তকাল ধরে)।
(৩) ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. ও আলী ইবনুল মাদীনী রহ.
বিশিষ্ট সমালোচক, ঐতিহাসিক, হাফেজ ইমাম আবূ উমর ইবনে আব্দুল বার جامع بيان العلم নামক গ্রন্থেও “তর্ক-বিতর্ক প্রতিষ্ঠাকরণ ও প্রমাণ উপস্থাপন” অধ্যায়ে আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ (যিনি আবুল ওয়ালীদ আল ফারাবী নামে পরিচিত) থেকে বর্ণনা করে বলেন তিনি বলেছেন
ইউসুফ ইবনে আহমদ (যিনি মক্কার মুসনীদ ইবনে দাখিল আস সায়দালানী নামে পরিচিত) আবূ জাফর আল আকীলী থেকে অনুমতিক্রমে আমাদের নিকট বর্ণনা করেন যে মুহাম্মদ বিন উত্তাব বিন আল মুরবা‘ (যিনি আবু বকর আল আ‘য়ান নামে খ্যাত) প্রশংসা করে বলেছেন আব্বাস বিন আব্দুল আ‘জীম আল আমবারী আমার নিকট বর্ণনা করে বলেছেন-
আমি আহমদ ইবনে হাম্বলের নিকট ছিলাম। এমন সময় আলী ইবনুল মাদীনী একটি সওয়ারীতে চড়ে তার নিকট আসলেন। বর্ণনাকারী বলেন-এরপর একসময় তারা শাহাদাতের (সাক্ষ্য প্রদানের) মাসআলা নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়লেন। তাদের কণ্ঠস্বরক্রমেই উঁচু থেকে উঁচু হতে লাগল। এমনকি আমি আশঙ্কাবোধ করলাম যে তাদের মাঝে হয়তো এখন অযাচিত কোন দুর্ব্যবহারের ঘটনা ঘটে যাবে। আহমদ ইবনে হাম্বল শাহাদাতের পক্ষে রায় দিচ্ছিলেন।
আর আলী তা অস্বীকার করে প্রত্যাখ্যান করছিলেন। এক সময় যখন আলী ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা করে (সওয়ারীতে আরোহণ করলেন) আহমদ ইবনে হাম্বল দাঁড়িয়ে গেলেন এবং তার উষ্ট্রীর রেকাব টেনে ধরলেন। (তখন তার চোখই আলীর চোখের সাথে কথা বলছিল। অনেক কথা আর হাজারো আকুতি ও আবেদন সেখানে ছিল উপস্থিত। হৃদয়ের ভালবাসা ও ভ্রাতৃত্ববোধ উষ্ণতা পৌঁছে দিচ্ছিল আত্মার গভীর থেকে আরো গভীরে।
এই ঘটনা বর্ণনা করার পর হাফেজ ইবনে আব্দুল বার বলেছেন আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) যাঁরা বদরে,হুদায়বিয়ায় শহীদ হয়েছেন কিংবা যাদের সম্পর্কে রাসূলের হাদীছে মারফূ বর্ণিত আছে তাদের জন্য জান্নাতের সাক্ষ্য দেয়া সঠিক এই মতের পক্ষে রায় দিচ্ছিলেন।
তবে এ ক্ষেত্রে এই শর্তারোপ করছিলেন যে তাঁরা তাঁদের দলভুক্ত হতে পারবে না যারা পরস্পরে (মুসলমান হয়ে) একে অপরের রক্তপাত ঘটিয়েছে। আর আলী ইবনে মাদানী তা অস্বীকার করছিলেন। কিন্তু এ ব্যাপারে কোন সহীহ হাদীস পেশ করেননি।
(সমাপ্ত) অবিশ্লেষিত পুরাতন পাণ্ডুলিপি থেকে এ বর্ণনাটুকু বাদ পড়ে গিয়েছে।
(৪) আবূ বকর আল আশআরী রহ. ও ইমাম দারাকুতনী রহ.
সুপ্রিয় পাঠক! আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের দু’জন ইমাম। যারা নিজেদের মত ও পথে ইখতেলাফ করেছেন। তাদের সম্বন্ধে একটি আজীব ঘটনা এখন আমি আপনার সামনে পেশ করছি।
হাফেয আবুল কাসেম বিন আসাকির আদ্ দিমাশ্কী তার স্বরচিত تبيين كذب المفترى নামক গ্রন্থে বর্ণনা করেন- একদা হাফেয আবূ যর আল হারাবীকে জিজ্ঞেস করা হলো (যিনি ইবনে আহমদ আল আশআরী আল মালিকীর গোলাম ছিলেন। যা الجامع الصحيح গ্রন্থের রেওয়ায়াতে আছে) তুমি তো হেরাতের বাসিন্দা! এরপরও কোত্থেকে তুমি মালেক ও আশআরীর মাযহাব গ্রহণ করলে?: আবূ যর বললো, একদা আমি হাদীসের অন্বেষণে বাগদাদ গমন করলাম এবং শাফী মাযহাবের অনুসারী ইমাম দারাকুতনীর দরবারে পড়ে থাকলাম। যিনি সে সময়ের মুহাদ্দিসীনে কেরামের ইমাম ছিলেন। একদিন আমি তার সাথে চলছিলাম। এমন সময় কাজী আবূ বকর ইবনে তাইয়িব আল বাকিল্লানী আল মালেকী আল আশআরী তাকে অতিক্রম করলেন। তখন দারাকুতনী তাকে এমনভাবে সম্মান করলেন যে আমি আশ্চর্যান্বিত হলাম। যখন তিনি তার থেকে আলাদা হলেন আমি জিজ্ঞেস করলাম হে আমার শ্রদ্ধেয় শাইখ এই ব্যক্তিটি কে? যাকে আপনি এমনভাবে সম্মান করলেন। ইতিপূর্বে অন্য কারো সাথে যা আমি দেখিনি।: তুমি কি তার পরিচয় জানো?: না।এরপর তিনি বললেন ইনি হলেন- সাইফুস সুন্নাহ আবূ বকর আল আশআরী। সেই থেকে আমি তার সাথে লেগে থাকি এবং ফেক্বাহ, উসূলে ফেক্বাহসহ দীনের সকল ক্ষেত্রে তার মাযহাব ও মতের অনুসরণ করতে শুরু করি। أو كما قالএই সকল ঘটনাবলীর মাঝে (যার সংখ্যা এরচেয়েও অনেক) ওলামায়ে কেরামের পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ, হৃদ্যতা ও মমত্ববোধ এবং একে অপরের প্রতি মূল্যায়ন ও মর্যাদাবোধের উজ্জ্বল ও হৃদয় কাঁপানো দৃষ্টান্ত রয়েছে। যদিও তাদের নিজেদের মাঝে মত-পথ ও চিন্তা-চেতনায় ছিল ইখতিলাফ। ছিল ভিন্নতা।
আমি رسالة الألفة بين المسلمين নামক গ্রন্থের ভূমিকায় যা উল্লেখ করেছি তা এখনেই সমাপ্ত। তবে দীর্ঘ আলোচনার জন্য সেখান থেকেই অবগতি লাভ করা উত্তম বলে মনে করি।
(৫) ইমাম আবূ হানীফা রহ. ও ইমাম মালেক ইবনে আনাস রহ.
আইম্মায়ে সালাফের এ সম্বন্ধীয় আরো একটি ঘটনা। যা কাজী আবুল কাসেম ইবনে আবুল আওওয়াম তার স্বরচিত فضائل أبي حنيفة وأصحابه নামক গ্রন্থের পাণ্ডলিপিতে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন আহমদ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে সালামা (যিনি ইমাম আবূ জাফর আত্তাহাবী নামে খ্যাত) আমার নিকট বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন- আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন জাবরূন ইবনে সাঈদ ইবনে ইয়াযীদ। তিনি বলেন- আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন আইয়ূব ইবনে আব্দুর রহমান আবূ হিশাম। তিনি বলেন- আমার নিকট বর্ণনা করেছেন মুহাম্মাদ ইবনে রশীদ সাহিবে ইবনে কাসেম। যিনি ছিলেন জলকুক্কুট বা গাংচিলের চেয়ে বেশী বয়স্ক। তিনি ইউসুফ ইবনে আমর হতে। তিনি আব্দুল আজীজ আদ্দারাওয়ারদী হতে কিংবা ইবনে আবূ সালামা হতে। তিনি বলেন-
আমি মসজিদে নববীতে এশার নামাযের পর ইমাম আবূ হানীফা ও মালেক ইবনে আনাসকে দেখলাম তারা পরস্পর আলাপ-আলোচনা ও মত বিনিময় করছেন। একসময় তাদের একজন সে কথা বুঝতে পারলেন যা তার সাথী বলেছেন তখন অপরজন থেমে গেলেন। কোনরূপ ভর্ৎসনা বা তিরস্কার করলেন না। অসন্তুষ্টও হলেন না। এমনকি এ কথাটুকুও বললেন না যে তোমার ভুল হয়েছে। পরিশেষে তারা সেই মজলিশেই ফজরের নামায আদায় করলেন।
(৬) ইমাম মালেক রহ. ও আবেদ আব্দুল্লাহ আল উমরী রহ.
সিয়ারূ আলামিন নুবালা নামক গ্রন্থে ইমাম মালেক রহ. এর জীবনীতে এসেছে যে (হাফেয ইবনে আব্দুল বার التمهيد নামক গ্রন্থে বলেছেন, আমি যা লিখেছি তা আমার স্মৃতি থেকে, মূল বিষয়টা আমার স্মরণ নেই) আবেদ আব্দুল্লাহ আল উমরী ইমাম মালেকের কাছে আমল ও একাকীত্বের তথা সন্ন্যাসী ও সংসারত্যাগী হওয়ার প্রতি উৎসাহ প্রদানপূর্বক একটি চিঠি প্রেরণ করেন। তার প্রতি উত্তরে ইমাম মালেক রহ.ও তার কাছে একটি চিঠি প্রেরণ করেন। তিনি তাতে লেখেন-
নিশ্চয়ই যেমনিভাবে আল্লহ তা‘য়ালা (সৃষ্টির মাঝে) রিযিক বন্টন করে দিয়েছেন (যেমন কেউ খাচ্ছে চাল কেউ খাচ্ছে গম। অথচ উভয়টাই তার রিযিক)। ঠিক তেমনি আমলসমূহকেও তিনি (মানুষের মাঝে) বণ্টন করে দিয়েছেন। সুতরাং কতক লোক তো এমন রয়েছে যাদেরকে তিনি নামাযে সুস্থিরতা দান করেছেন। কিন্তু রোজার ক্ষেত্রে নয়। আবার কতক লোক এমনও রয়েছেন যাদেরকে দান-সদকায় সুস্থির করে দিয়েছেন। কিন্তু রোজার ক্ষেত্রে দেননি। আবার কতক লোক এমনও আছে যাদেরকে তিনি সফলতা দিয়েছেন যুদ্ধের ময়দানে, জিহাদে।
অতএব ইলমের প্রচার প্রসার তো সর্বোত্তম পূণ্যকর্মেরই একটি। আল্লাহ তা’য়ালার পক্ষ থেকে আমাকে যে বিষয়ে যে আমলে স্থির করা হয়েছে আমি তাতে সন্তুষ্ট, পরিপুষ্ট। আমি এ কথা মনে করি না যে আমি যে বিষয় নিয়ে আছি তা, আপনি যে বিষয় নিয়ে আছেন; তা ভিন্ন অন্য কিছু। আশা করি আমরা উভয়েই কল্যাণ ও পূণ্যের মাঝেই আছি।
(৭) ইমাম শাফেয়ী রহ. ও ইসহাক ইবনে রাহুয়া রহ.
الإحياء নামক গ্রন্থের সংকলক ইমাম গাযালী রহ.। তার গ্রন্থের যে স্থানে সালফে সালেহীনের মুনাযারাসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন আল্লামা মুরতাযা আয্ যুবাইদী রহ. তার ব্যাখ্যাগ্রন্থ شرح الإحياء এর সে স্থানে সালফে সালেহীনের মাঝে কিভাবে মুনাযারা হতো, কিভাবে তারা পারস্পরিক আদব ও শিষ্টাচার ইহতিরাম ও সম্মানের সাথে সত্যের অনুগত হতেন এবং সত্যকে মেনে নিতেন তার আলোচনা করেছেন।
তন্মধ্যে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. এর উপস্থিতিতে ইমাম শাফী রহ. এর সাথে ইসহাক ইবনে রাহুয়ার মুনাযারা বা বিতর্ক-আলোচনা একটি। যা আমি হাফেজ আবুল হাসান বাদাল ইবনে আবুল মুয়াম্মার আত্তিবরিযী আশ্ শাফেয়ী রচিত كتاب الناسخ والمنسوخ নামক গ্রন্থে পড়েছি।
যার মূল উদ্ধৃতি হলো- আমার নিকট বর্ণনা করেছেন খতীব আবূ বকর ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে ইব্রাহীম ইবনে আলী। তিনি বলেন আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন ইয়াহইয়া ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব আল আব্দী। তিনি বলেন আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন কাতেব মুহাম্মাদ ইবনে আহমদ। তিনি বলেন আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন হাফেজ আবুশ শাইখ তিনি বলেন-
বর্ণিত আছে যে ইসহাক ইবনে রাহুয়া রহ. ইমাম শাফী রহ. এর সাথে “মৃত প্রাণীর দাবাগতকৃত বা পরিশুদ্ধ চামড়া পাক কি নাপাক” এ বিষয়ে বিতর্কে লিপ্ত হলেন। তখন সেখানে আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. উপস্থিত ছিলেন। ইমাম শাফী রহ. বললেন- মৃত প্রাণীর চামড়ার দাবাগত তথা পরিশুদ্ধকরণই হলো চামড়ার পবিত্রতা। তখন ইসহাক রহ. ইমাম শাফী রহ.কে বললেন, আপনার মতের পক্ষে কি কোন দলীল আছে? প্রতুত্তরে তিনি বললেন- হাদীসে যুহরী (আমার মতের পক্ষে দলীল)। যা বর্ণিত হয়েছে উবায়দুল্লাহ বিন আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল্লাহ থেকে। তিনি ইবনে আব্বাস র. থেকে তিনি মাইমুনা র. হতে বর্ণনা করে বলেন- নবী করীম স. বলেছেন “কেন তোমরা মৃত প্রাণীর দাবাগতকৃত চামড়া কাজে লাগালে না!?”
তখন ইসহাক রহ. তার সামনে (নিজ মতের পক্ষে) ইবনে উকাইমের হাদীস পেশ করে বললেন যে, নবী করীম স. তার মৃত্যুর মাত্র এক মাস পূর্বে আমাদের নিকট এই মর্মে পত্র প্রেরণ করেছেন যে, তোমরা মৃত প্রাণীর চামড়া কোন কাজে লাগিয়ো না। চাই তা দাবাগতকৃত হোক বা অপরিশুদ্ধ হোক। সুতরাং এই হাদীসটিই তো মায়মূনা র. এর হাদীস রহিত হওয়াকেই বুঝাচ্ছে। কারণ এই পত্রটি এসেছিল রাসূল স. এর মৃত্যুর মাত্র এক মাস পূর্বে।
তার কথা শুনে শাফী রহ. বললেন- এটা হলো পত্র আর সেটা হলো শ্রুত (আর শ্রুত বিষয় তো পত্রের থেকে সুদৃঢ় হয়ে থাকে। অথচ রহিত করার জন্য একটি বিষয় অপর কোন বিষয়ের সমকক্ষ বা তার চেয়ে দৃঢ় হতে হয়।)
ইসহাক রহ. বললেন- নবী করীম স. তো কেসরা এবং কায়সারের নিকট ও পত্র পাঠিয়েছিলেন। আল্লাহ তা’য়ালার নিকট সে পত্রটি তো তাদের মাঝে (অর্থাৎ রাসূল স. এর দাওয়াতী কর্তব্য ছিল কেসরা ও কায়সারকে দীনের দাওয়াত দেয়া। আর তিনি তা পত্রের মাঝে আদায় করেছেন।) ঠিকই দলীল হয়েছে। (সুতরাং এখানেও তা মায়মূনা র. এর হাদীস মানসূখ হওয়ার জন্য যথেষ্ট) এরপর ইমাম শাফী রহ. চুপ করে গেলেন।
(বিখ্যাত আলেমে দীন) তাজ আস সাবকী এই মুনাযারা হয়ে যাবার পর طبقات الشافعة الكبرى নামক গ্রন্থে যা বলেছেন তার সার সংক্ষেপে হলো- ইমাম শাফী রহ. এর চুপ হয়ে যাবার কারণ হলো ইসহাক রহ. এর প্রশ্ন উত্থাপনটা সঠিক স্থানে হয়নি। ফলে চুপ করে যাওয়া ছাড়া তার আর কোন উত্তর ছিল না। কেননা ইবনে উকাইমের পত্রটি ছিল এমন একটি পত্র যার বিপরীত মুখে ছিল শ্রুত একটি হাদীস। তদুপরি সেই পত্রটি যে শ্রুত হাদীসের পরে প্রেরিত হয়েছে তাও সুনিশ্চিত নয়। বরং তারিখের নিকটবর্তীতার কারণে কেবল এক প্রকার ধারণাই করা হয়েছে। আর শুধুমাত্র এতটুকু বিষয় রহিত করণকে কার্যকর করতে পারে না।
অথচ অপরদিকে রাসূল স. এর সেই পত্র দু’টির বিরোধিতায় কোন কিছুই ছিল না। বরং বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক বিষয় সে দু’টি পত্রকে আরো সুদৃঢ় করেছে। তাছাড়া সেই পত্রে যা ছিল নবী করীম স. তার দাওয়াত নিয়েই (পৃথিবীতে) এসেছিলেন এই নির্দেশক বাণীর ধারাবাহিক পরম্পরাও তাকে সমর্থন করেছে। (যুবাইদী রহ. এ কথাটুকু شرح الإحياء নামক গ্রন্থেও বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এর উপর ভিত্তি করে হাদীসে ইবনে উকাইমের পক্ষে কোন প্রশ্ন করাই তো অবান্তর)।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. যখন এ আলোচনা শুনতে পেলেন তখন তিনি ইবনে উকাইমের হাদীস গ্রহণ করলেন এবং তার উপরই ফতওয়া দিলেন। আর ইসহাক রহ. (সত্যকে অনুধাবন করে ইমাম শাফী রহ. এর পেশকৃত হাদীসে মায়মূনা র. কে গ্রহণ করলেন।
আবুল হাসান আত্ তিরমিযী রহ. বলেন- আমি বলছি যে, খল্লাল তার গ্রন্থে এই তথ্য বর্ণনা করেছেন যে ইমাম আহমদ রহ. ইবনে উকাইমের হাদীসের ব্যাপারে তাওয়াক্কুফ করেছেন অর্থাৎ তা গ্রহণও করেননি, আবার বর্জনও করেননি। যখন তিনি সেই হাদীসের রাবীদের দৃঢ়তা দেখতে পাননি। আর কেউ কেউ বলেছেন তিনিও ইবনে উকাইমের হাদীস ছেড়ে মায়মূনা র. এর হাদীস গ্রহণ করেছেন।
তবে এ ব্যাপারে ইনসাফের পথ ও পন্থা হলো এ কথা বলা যে হাদীসে ইবনে উকাইমের বাহ্যিক নির্দেশনা রহিতকরণকেই বুঝাতো যদি তা সহীহ হতো। কিন্তু এই হাদীসটি বেশ গোলযোগপূর্ণ। এরপরেও কথা হলো সেটা সহীহ হওয়ার দিক থেকে হাদীসে মায়মূনার সমকক্ষও না।
আবূ আব্দুর রহমান আন নাসায়ী বলেন- (মৃত প্রাণীর দাবাগতকৃত চামড়া পাক না নাপাক) এই অধ্যায়ের সর্বাপেক্ষা সহীহ হাদীস হলো হাদীসে মায়মূনা র.। আমরা আব্বাস আদ্দূরী থেকে রেওয়ায়াত করেছি যে ইয়াহয়া ইবনে মুয়ীনকে জিজ্ঞেস করা হলো এই দু’টি হাদীসের মধ্য হতে তোমার কাছে কোনটি বেশী প্রিয়? তখন সে হাদীসে মায়মূনা র. এর দিকেই ইঙ্গিত করেছেন।(شرح الإحياء থেকে আমি যা বর্ণনা করেছি তা এখানেই সমাপ্ত)
প্রিয় পাঠক! দেখুন, লক্ষ্য করুন ইসহাক রহ. কীভাবে স্বীয় মতামত থেকে সরে এলেন যখন তার সামনে সত্য আত্মপ্রকাশ করলো। আর ইমাম শাফী রহ. এর আদব ও শিষ্টাচার বিনয় ও নম্রতাকে। দেখুন! কীভাবে তিনি চুপ করে রইলেন যখন তার প্রতিপক্ষের সামনে সত্য প্রকাশ পেল।
(৮) আমর ইবনে উবাইদ রহ. ও ওয়াসেল ইবনে আত্তার
আমর ইবনে উবাইদের এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল যে তিনি কোন এক মাসআলায় একটি রায় দিলেন। কিন্তু তা ছিল ভুল। পরবর্তীতে কোন এক সময় এ বিষয়টি নিয়ে ওয়াসেল ইবনে আত্তার সাথে তার বাদানুবাদ হলো এবং সেই মাসআলায় আমর ইবনে উবাইদের সামনে তার ভুল ধরা পড়ল।
তখন এই বলতে বলতে সত্য ও সঠিক মত গ্রহণ করলেন যে আমার আর সত্যের মাঝে তো কোন প্রকার শত্র“তা নেই। (সুতরাং সত্য গ্রহণে আমার বাঁধা কোথায়!)
(৯) আব্দুর রহমান ইবনে মাহদী রহ. ও উবাইদুল্লাহ ইবনে হাসান
হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী تهذيب التهذيب নামক গ্রন্থে উবায়দুল্লাহ ইবনে হাসান আল আম্বরীর জীবনীতে (যিনি ১৬৮ হিজরী সনে ইন্তেকাল করেন। বসরার অধিবাসী একজন বিজ্ঞ আলেম,ফকীহ ও একজন সর্দার ছিলেন। সেখানকার কাজীর পদ তার দ্বারা অলংকৃত ছিলে।) বর্ণনা করেন যে, উবায়দুল্লাহর শিষ্য আব্দুর রহমান ইবনে মাহদী বলেন-
আমরা একটি জানাযায় উপস্থিত ছিলাম। তখন আমি তাকে একটি মাসআলা সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলে তিনি তাতে ভুল মতামত দিলেন। আমি বললাম আল্লাহ তা‘য়ালা আপনাকে সঠিক বুঝ দান করুন। সঠিক কথা হবে এমন এমন। তিনি মাথা নিচু করে সামান্য ভাবলেন এবং একটু পরই আচমকা মাথা তুলে বললেন আমি আমার মত থেকে সরে আসছি। কারণ বাতিলের মাথা হওয়া অপেক্ষা হকের লেজ হয়ে থাকা আমার কাছে অনেক প্রিয়। (রহ.)
শেষ কথা
যখন সত্য আত্মপ্রকাশ করেছে তখন সত্যকে গ্রহণ করায় পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব ও কল্যাণকামীতায়, হৃদ্যতা ও নম্রতায় আমাদের আইম্মায়ে সালাফের হালত এমনই ছিল। তারা যখন সত্য অনুধাবন করতেন তখন তারা সেই সত্যকে দ্রুততার সাথে গ্রহণ করতেন। অপরদিকে নিজেদের মতামতের ভ্রান্তি যখন উন্মোচিত হতো তখন তা বর্জন করতেন এবং তা থেকে সরে আসতেন। তাদের মনোভাব আর দৃষ্টিভঙ্গি তো একটিই। আর তা হলো সত্য ও সত্যান্বেষণ, ইখলাস ও একনিষ্ঠতা।
এই ধরনের আরো লেখা পড়তে নিয়মিত আমার মাদরাসা ভিজিট করুন। কমেন্ট বক্সে আপনার মতামত জানান ও পরামর্শ দিন। সবার সাথে শেয়ার করুন।
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতে উত্তম প্রতিদান দান করুন আমীন।