চরমোনাই পীর সৈয়দ ফজলুল করীম রহ. এর জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো।
সুপ্রিয় পাঠক!
২৬ নভেম্বর ২০০৬ সাল। আমি বন্ধুদের সাথে মরহুম চরমোনাই পীর সাহেব সৈয়দ ফজলুল করীম রহ. এর জানাযায় উপস্থিত হতে পেরেছিলাম। জানাযা শুরুর পূর্বে বিভিন্ন রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছিলেন। এক পর্যায়ে মরহুমের একজন সুযোগ্য পুত্র “মৃত্যুর পূর্বাবস্থা সম্পর্কে” বর্ণনা দিয়েছিলেন।
সে সময় লেখার একটি ঝোক ছিল। তাই কথাগুলো নোট করে নিয়েছিলাম এবং মাদরসায় ফিরেই গল্পাকারে তাকে তুলে ধরি। লেখাটি একটি “মাসিক পত্রিকাতে” প্রকাশিতও হয়েছিল। যা আজকে আপনাদের সাথে এখানে শেয়ার করেছি।
২৫ নভেম্বর, ২০০৬। পূর্বাকাশে রক্তিম আভা ছড়িয়ে সূর্য উঠেছে। কোমল মিষ্টি আলোর ধারা ক্রমাগত নেমে আসছে ধরাপৃষ্ঠে। শিশিরভেজা প্রাকৃতিক সবুজের সমারোহে সবাই হয়েছে ভাব-তন্ময়,উৎফুল্ল। কুসুমকলিরা আপন মনে সুবাস ছড়িয়েছে। পত্রপল্লবেরা ফিরে পেয়েছে এক অনন্য সজীবতা।মানুষের কর্মব্যস্ততা,আকাশের নীলিমা নদ-নদীর স্রোতধারা আর পাহাড়ী ঝড়ণার কলকলানি,পাখপাখালীর কিচির-মিচির ধ্বনির মধুরতা,মানুষের উচ্ছ্বাস-উৎফুল্লতা আর আনন্দ-বিনোদন সবকিছুই সেদিনের প্রকৃতিকে সুষমিত করেছে স্বতঃস্ফুর্তভাবে।
সৈয়দ ফজলুল করীমের (রহ.) জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো
সবুজে ঢাকা যেন ছবিতে আঁকা একটি গ্রাম চরমোনাই। যার গা ঘেষে বয়ে গেছে কীর্তনখোলো নদী। কেন যেন বুকভরা তার কাঁদো কাঁদো ভাব। কেন ? তার কি কোন দুঃখ আছে ? মনে হয় না! নদীরতো কোন দুঃখ পাবার কথা নয়! সে তো উদার ,উদাররা তো দুঃখ দিলেও দুঃখ পায় না।
তবে কী সে কারণ? কেন তার বিশাল ব্যপ্ত বক্ষ আজ ছলছল করে উঠেছে!তুমি জান,হে বন্ধু? আমি কিন্তু জানতাম না। তবে এখন জানি।
সকাল ৭.০০টা বাজে
তখন বাজে সকাল সাতটা। চরমোনাই মাদরাসার কুতুবখানায় একজন বুজুর্গ ওলীয়ে আল্লাহ বসে আসেন। গায়ে লম্বা সফেদ আলখেল্লা। মাথায় সাদাসিধে পাঁচকল্লি টুপি। চেহারায় নূরের ঝলকানি। দেহজুড়ে উজ্জল আভিজাত্যের ছাপ। চোখে শীতলতা।
যেন মায়া মমতারা সেখানে স্বাচ্ছন্দে স্থায়ী নিবাস গড়েছে। তার যবানটা আল্লাহর স্মরণে সদা ব্যস্ত। ললাটের মাঝে কৃষ্ণ কালো দাগ যেন তা পাক্কা মুমিনের পরিচায়ক হয়ে আছে। আর মুখমণ্ডলকে করেছে নূরে নূরান্বিত। জান,তিনি কে? তিনি এক মহান ব্যক্তি।
শান্তিকামী, মুক্তিকমী, দিশেহারা মুসলিম জনতার হৃদয়ের ইমাম। আলোর মিনার। প্রাণের আত্মা। লাল সবুজের পতাকায় আঁকা স্বাধীন বাংলাদেশের একজন অন্যতম হক্কানী পীর হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ ফজলুল করীম পীর সাহেব চরমোনাই।
চরমোনাই কুতুবখানা
চরমোনাই কুতুবখানা একটি সুপ্রসিদ্ধ কুতুবখানা। তার চারপাশের রুপটা একেবারেই ছিমছাম। সৌন্দর্যবর্ধক উপকরণ সেখানে অনুপস্থিত। একটি এসিই যা ছিল। দক্ষিন পাশে নীচু একটি চৌকি। এসব মিলে কুতুবখানার হুজরাটিতে আসবাবপত্রের অপ্রতুলতা থাকলেও পরিচ্ছন্নতার পরিস্কার ছাপ বর্তমান।
এ কুতুবখানাটি আর দশটা কুতুবখানার মতো কিতাবাদীতে সুসমৃদ্ধ নয়। তবে এখন মাহফিলের মওসুমে তা সেই আল্লাহওয়ালার বিশ্রামাগার। অন্য সময় তাঁর হেফজখানার রুপে রুপায়িত হয়।
কুতুবখানার দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলেন হযরত মাওলানা মুফতী সৈয়দ রেজাউল করীম সাহেব। রুপে-গুণে সেই বুজুর্গ ব্যক্তিকেই যেন ছুঁই ছুঁই। কেনই বা হবে না? তিনি তো তাঁর ঔরসজাত সন্তান। বাবার মুখপানে তাকিয়ে…
: আব্বা কিছু বলবেন বলে মনে হচ্ছে! কথাটা বলতে বলতে শীতের সকালে পাকা মেঝেতে বসতে গেলেন রেজাউল করীম সাহেব।: না,না, ওখানে বোসো না। ঠাণ্ডা লাগবে। ঐ ছোট্র চৌকিতে গিয়ে বসো। হুজরার উত্তর-পশ্চিম কোণ ঘেষা ছোট্র চৌকিটির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন পীর সাহেব হুজুর। একটু পর ওষ্ঠাধর কাঁপিয়ে তিনি বললেন- “আমার কেমন যেন একটু শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।: আব্বা! ঠাণ্ডা লাগেনি তো?: হয়তো বা তাই হবে!
ডাক্তার সাহেব কোথায়?
: আচ্ছা,আমি ডাক্তার সাহেবকে ডেকে পাঠাচ্ছি বলেই মোবাইলের বাটনগুলো একের পর এক টিপতে লাগলেন রেজাউল করীম সাহেব। রিং বাজতে লাগলো। ওপর পাশ থেকে রিসিভ করা হলো।: আসসালামু আলাইকুম।: ওয়ালাইকুমুসসালাম। বারডেম হাসপাতালের একজন সুচিকিৎসক ডাঃ আলী আকবর সাহেব। পীর সাহেব হুজুরের ব্যক্তিগত চিকিৎসক তিনি।: ডাক্তার সাহেব বলছেন?: জি হ্যাঁ, তা আপনি কেমন আছেন?: ভালো, তবে আব্বার কেমন যেন একটু শ্বাস কষ্ট হচ্ছে…।: আমি এখনি আসছি। আপনি কোন টেনশন করবেন না। তাঁর কথা থামিয়ে দিয়ে ওপাশ থেকে ডাক্তার সাহেব বললেন।
দাও একটি পান বানিয়ে। বললেন পীর সাহেব। মায়াভরা চোখ আর কোমল দু’টি হাতে সুন্দর করে একটি পান বানালেন সৈয়দ রেজাউল করীম সাহেব। মূর্তিমান দেহে শ্রদ্ধাভরে দু’টি হাত এক করে প্রাণপ্রিয় পিতার হাতে পানটি তুলে দিলেন।
আর পীর সাহেবও অন্যান্য দিনের মতোই মজা করে পান চিবুতে লাগলেন। ফাঁকে ফাঁকে চলছিল নানা বিষয়ের খবরা-খবর। আলাপ আলোচনা আর পর্যালোচনা।
সময় গড়িয়ে তখন ৮.৩০ মিনিট
সময়ের দৌড় তখন ৮:৩০ এর কাঁটা ছাড়িয়ে গেছে। ডাক্তার সাহেব এসে পড়েছেন। প্রথমেই প্রেসার মাপলেন। ১৪০-১৮০-৮৫। সেখানে কোন সমস্যা পরিলক্ষিত হলো না। কিন্তু রক্তের সুগারে ঘাটতি হতে পারে এমনটা ভাবলেন ডাক্তার সাহেব।
রেজাউল করীম সাহেবকে লক্ষ করে বললেন-কিছু গ্লুকোজের শরবত খাইয়ে দিন। রেজাউল করীম সাহেব পরপর দু গ্লাস শরবত বানিয়ে দিলেন। পীর সাহেবও পরমানন্দে তার পুরোটাই পান করলেন।
ডাক্তার সাহেব চলে গেছেন। আলোচনায় সরব কক্ষ নীরব হয়ে গেছে। ডাক্তার সাহেবের উপস্থিতি যাদেরকে অজানা আশংকায় কক্ষে সমবেত করেছিল তারাও নিজ নিজ কাজে বেরিয়ে গেছেন।
রয়ে গেছেন শুধু রেজাউল করীম সাহেব। নির্নিমেষ নেত্রে তাকিয়ে আছেন পিতার নূরানী চেহারা মোবারকের দিকে। পিতা কখন কি আদেশ করেন সে ভাবনায় তখন তিনি তন্ময়।
চৌকিতে বসে আছেন পীর সাহেব
পীর সাহেব চৌকির উপর বসে আছেন। তার পাশে অতি কাছেই বসে আছেন রেজাউল করীম সাহেব। ঘড়ির কাঁটা নয়টার ঘরে চলে এসেছে। কারো মুখে কোন কথা সরছে না। সারা কক্ষে নীরবচ্ছিন্ন নীরবতা। সবকিছু থেকেই সরবতাকে হরণ করা হয়েছে।
কিন্তু ব্যতিক্রম ছিল কেবল রেজাউল করীম সাহেবের দু’টি চোখ। যা অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি মেলে রেখেছিল পরম প্রিয় পিতার পুরোটা মুখজুড়ে।
যমীনের উপরে শেষ নিদ্রা
আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। সমস্ত নিস্তব্ধতা আর নিরবতা ভেঙ্গে কথাটি বললেন পীর সাহেব। তাঁর কথা শেষ হতেই বিস্ময়ভরা চোখে রেজাউল করীম সাহেব দেখলেন। তাঁর শায়েখ শ্রদ্ধেয় পিতার জিহবাটা আচমকা দ্রুত থেকে দ্রুত অতি দ্রুত নড়তে শুরু করেছে। বুঝতে পারলেন কী যেন পড়তে লেগেছেন।
এক সময় পীর সাহেব হুজুর তাঁর মাথাটা আস্তে করে ছেলে রেজাউল করীম সাহেবের হাত দু’টোয় রাখলেন। রেজাউল করীম সাহেব ভাবলেন আব্বা কি ঘুমিয়ে পড়েছেন! ভাবতে ভাবতে ললাটে কয়েকটা ভাজ ফেললেন। আলতোভাবে আস্তে করে পিতাকে বিছানায় শুইয়ে দিলেন।
সন্তানের অস্থির মন
কিন্তু মনটা কেমন যেন আনচান করছে তাঁর। ভ্রু-দু’টো থেমে থেমে কেঁপে উঠছে। চোখের মণিতে আশংকার সুস্পষ্ট ছাপ। মনের কোঠায় ভাবনারা ঘুরপাক খাচ্ছে। আজ সবকিছুই একটু ব্যতিক্রম মনে হচ্ছে ? নিজেকে নিজেই যেন প্রশ্নটা করলেন। কোন অঘটন! তাড়াতাড়ি করে পিতার নাকের ডগায় হাত রাখলেন।
অনুভব করলেন উষ্ণতা। যেন আত্মায় পানি খুঁজে পেলেন। নাহ্ তেমন কিছু না বলে মাথা বার কয়েক ডানে বায়ে দোলালেন। আনমনে বললেন- হয়তো গভীর ঘুম আসায় ঘুমিয়ে পড়ার পূর্বেই অন্য দিনের চেয়ে একটু তড়িঘড়ি করে দু’আ পড়ে নিয়েছেন।
এতসব ভাবার পরও শংকার কৃষ্ণ ছায়া ভেতরে ভেতরে রয়েই গেল।
ঘড়ির কাটায় তখন ৯.৪০ মিনিট
নয়টা বেজে চল্লিশ মিনিট। মনির নামের এক ছেলে আনমনা মনে কুতুবখানায় প্রবেশ করল। অমনি পীর সাহেব হুজুরের ডান চোখটি খুলেই বন্ধ হয়ে গেল। যেন কাউকে টিপ্পনি কাটলেন। এরপরই তাঁর উষ্ঠাধরে ফুটে উঠল নিটল বিমল এক চিলতে মুচকি হাসি। সাথে সাথে ছেলেটি এদিক ওদিক দেখল।
যখন আশপাশে কাউকে দেখতে পেল না ভাবল হয়তো তাকেই ডেকেছেন। কিন্তু তার কেমন যেন ভয় ভয় করছে। একে তো চোখের টিপ্পনি তার উপর আবার এমন পবিত্র হাসি। অবাক আর বিস্ময়ের সমুদ্রে সে তখন নিমজ্জিত।
মনির হতভম্ব হয়ে পড়ল
চিন্তার মোড় দ্রুত থেকে দ্রুত ঘুড়তে লাগল। তিনি তো আমাকে এভাবে ডাকার কথা নয়! আমি তো এমন হাসি পাবার যোগ্য নই। কত কাছে এসেছি সেবা শুশ্র“ষা করেছি। তখনও তো এমন বিমল হাসি দেখিনি। কখনও উপহার পাইনি। তাহলে কাকে দেখলেন!! কাকে উপহার দিলেন এ হাসি?
বিষয়টা কেমন কেমন লাগছে। প্রবেশমাত্র যে শ্বাস প্রশ্বাসের যে আওয়াজটুকু হচ্ছিল এখনতো তাও নেই। সারাটা হুজরায় পিনপতন নীরবতা নেমে এসেছে।
এ চিন্তা মাথায় আসতেই তার শরীরের পশমগুলো শির শির করে দাঁড়িয়ে গেল। দেহটা আচমকা কেঁপে উঠল। দৃষ্টি আবছা হয়ে হয়ে আবার ফিরে এল। কিভাবে কি করবে খুঁজে পাচ্ছিল না।
নিজের সাথে লড়াই
নিজেকে স্বাভাবিক করতে আপন মানসিকতার সাথে একপ্রকার লড়াই করতে হলো। এক ধ্যানে কিছুক্ষণ ভাবার পর দুরু দুরু বুকে পীর সাহেব হুজুরকে ডাক দিল- হুজুর! কোন সাড়া মিলল না। আবার ডাক দিল। তাও অদৃশ্যে মিলে গেল। দমিয়ে রাখা আশংকাগুলো ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগল। তবু সেসব উপেক্ষা করে হিম্মতের সাথে পীর সাহেবের হাত স্পর্শ করল সে।
এতো ঠাণ্ডা কেন? ঠাণ্ডা কেন! ঠাণ্ডা কেন! বলতে বলতে চাপা আর্তচিৎকার করতে লাগল- হায়! হায়! বুকের শংকাগুলো যেন সত্য না হয় সেজন্য একের পর এক চিৎকার করে ফরিয়াদ জানাতে লাগল বিশ্ব প্রতিপালকের দরবারে।
সত্যিই বিলম্ব হয়ে গেছে!
কিন্তু তখন দেরি হয়ে গেছে। সে ধীরে ধীরে শিরায় হাত রাখল। সেখানে কোন স্পন্দন অনুভূত হলো না। নিস্তেজ হয়ে গেছে দেহ। চির নিস্তেজ। হাড়ানোর প্রচণ্ড ব্যথায় ছেলেটি সেখান থেকে নড়তে পারলো না কিছুক্ষণ। আইসবার্গের মত স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। অথচ উষ্ণ অশ্র“ সমুদ্রের লোনাজল তার দুগণ্ড পেরিয়ে বুক ভাসিয়ে চলেছে। আত্মার আর্তচিৎকারে সারাটা দেহ প্রকম্পিত হয়েই চলেছে।মুহুতেই এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল বাংলার আকাশ বাতাস নদী ও সাগর সগর বন্দর ছাড়িয়ে বিশ্বের আনাচে কানাচে। সাথে সাথে ভক্ত মুরিদানদের মাঝে ক্রন্দন আর আহাজারির যে রোল উঠছে তা আজও মুমিনের হৃদয় কা‘বাকে নাড়িয়ে দেয়। গায়ের লোম শিউরে দেয়।
আল্লাহ তা‘য়ালা তাঁকে জীবনের সকল ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করে দিয়ে জান্নাতের সুঁঊচ্চ মাকাম দান করুন, আমীন।